লিটন ইসলাম
১৭ জুলাই, ২০২৪
(ছবি: সমকাল)
ঘড়িতে তখন বিকাল চারটা। আমি পেশাগত দায়িত্ব পালনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে ছিলাম।
সেখানে শিক্ষার্থীরা গায়েবানা জানাজা শেষ করে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে টিএসসির দিকে রওনা দিল। সেই সময় ভিসি চত্বরে চার ধরণের নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান। ওইদিকে টিএসসিতেও অবস্থান ছিল বিপুল সংখ্যক পুলিশ, বিজিবি, র্যাবের। সাথে বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র।
আমি খেয়াল করলাম শিক্ষার্থীরা খুব শান্তশিষ্টভাবে মিছিল নিয়ে টিএসসির দিকে চলে যাচ্ছে। এমন সময় টিএসসি ও ভিসি চত্বর থেকে পুলিশ এলোপাথাড়ি টিয়ারশেল আর সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা শুরু করল।
মাঝখানে কলাভবনের গেট খুলে রাখা হয়েছে যাতে শিক্ষার্থীরা সেখান দিয়ে বের হয়ে যায় কিন্তু দুদিক থেকে পুলিশের টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের আঘাতে শিক্ষার্থীরা রীতিমত নির্বাক।
তাদের ধারণা ছিল, পুলিশ আক্রমণে যাবে না। টিয়ারশেলের ধোঁয়া আমার চোখেও লাগল। পাশেই সাউন্ড গ্রেনেড পড়ল অনেকবার।
শিক্ষার্থীরা বারবার একত্র হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ একশন মুডে ছিল। এরপর হলপাড়ার (বিজয় ৭১ হল, বঙ্গবন্ধু হল, জসীম উদ্দিন হল ও জিয়া হল এলাকা) দিকে এগিয়ে যেতে লাগল পুলিশ। হলের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সময় দিল ছয়টার মধ্যে হল ছাড়তে হবে কিন্তু শিক্ষার্থীদের দাবি তারা কোনভাবেই হল ছাড়বেন না।
কিন্তু পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা ঢুকে পড়ল হলপাড়ায়। এলোপাথাড়ি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা শুরু করল। এতে করে হলে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা হল।
সবাই তখন পড়নে যা ছিলো তাই নিয়ে হল ছাড়া শুরু করল। কেউ কেউ ছোট ছোট ব্যাগে করে তাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে হল ছাড়তে থাকল।
শিক্ষার্থীদের টিএসসি দিয়ে হল ছাড়তে বলা হল। কিন্তু টিএসসি পেরিয়ে বিপদে পড়তে হয় অনেক শিক্ষার্থীদের। শাহবাগ মোড়, নীলক্ষেত মোড়, হাতিরপুল মোড়ে আগে থেকেই দেশীয় অস্ত্র হাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান নেয়।
আমার কাছে অনেকেই ইনবক্সে ছবি পাঠিয়েছেন, অনেকেই ফোন করে জানান যে, যারাই এইসব রাস্তা দিয়ে গেছেন তাদেরকেই নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে।
আমাদের এক সাংবাদিক ছোট ভাই ও এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী তাকে বিদায় দিলাম সন্ধ্যা ছয়টার কিছু পরে। বিদায় দিয়ে আমি আর জাগো নিউজের হাসান টিএসসির দিকে যাব।
কিন্তু ছোট ভাইকে বিদায় দিয়ে যখন টিএসসিতে গেলাম এরপর শুনলাম তাকে বেদম মারপিট করে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী এবং সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হচ্ছে তাকে যারা পিটিয়েছে তাদের বেশিরভাগই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
সেখানে উপস্থিত বিবিসি বাংলার সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন তাকে রক্ষা করে রিকশা করে পাঠিয়ে দেয়।
রাত ১টা ৪৩ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাই তার রক্তাক্ত ছবি ইনবক্স করে জানাল তাকে ও তার বন্ধুকে বেদম মারপিট করেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ঘটনাটি ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই হাতিরপুল বাজার মোড়ে।
ইনবক্সে ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থীর দেয়া মেসেজ ছিলো এরকম, “আমি এবং আমার বন্ধু হল থেকে রিক্সা করে কল্যাণপুর যাচ্ছিলাম। এ সময় আমাদের কাছে ব্যাগ দেখে লাঠিসোঠা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মহানগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বলে উঠল “এই এরা ভার্সিটির ছাত্র, ব্যাগ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে, মার এদের” বলেই এলোপাথাড়ি মারধর শুরু করেছে। পরবর্তীতে স্থানীয়দের সহযোগিতায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের….
[লিটন ইসলাম দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক]