ভিনগ্রহের সন্ধানে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ

বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে,
বহু ব্যয় করে বহু দেশ ঘুরে,
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু….

সিন্ধু দর্শনের পর হয়তো ধানের শীষের বিন্দু দেখার জন্য আপনার মন আকুল হতেই পারে তবে জেমস ওয়েবের স্পেস টেলিস্কোপের চোখ দেখে অতীত থেকে অতীতে। মানব সভ্যতার অন্যতম কৌশলী দূরবীনের তকমা পাওয়া জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপকে পাঠানো হয়েছিল গত ২৫ শে ডিসেম্বর ২০২১ এ।

চন্দ্র অভিযান, মঙ্গলে রোভার ল্যান্ড করা যতটা না চ্যালেঞ্জিং তারচেয়ে চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ ছিল টেলিস্কোপটিকে ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট-৩ এ স্থাপন করা। সেখানে পাঠানোর ক্ষেত্রে ৩৪৪ টি সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ স্টেপ ছিল, যার যেকোনো একটি পয়েন্টে ঠিকভাবে কাজ করতে না পারলে পুরো মিশনটিই ব্যর্থ হতে পারত। ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট হল পৃথিবী, সূর্যের মহাকর্ষের প্রভাবে সৃষ্ট সৌরজগতের এমন কিছু স্থান যেখানে কোনো বস্তুকে স্থাপন করলে বস্তুর উপর কোনো বল প্রয়োগ করা ছাড়াই তা সাম্যাবস্থা লাভ করে। সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থিত ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট ২, এ স্থানে টেলিস্কোপটিকে স্থাপন করার মূল কারন সূর্য থেকে সর্বোচ্চ দূরত্ব বজায় রাখা। কেননা জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে রয়েছে নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা যা অত্যন্ত তাপ সংবেদী। সূর্য থেকে নির্গত তাপ টেলিস্কোপের কাজে বিঘ্ন ঘটাতে পারে তাই সর্বোচ্চ দূরত্বে অবস্থান করার পাশাপাশি সূর্যের দিক করে রাখা টেলিস্কোপের একটি সংযুক্ত সিলিকন শিল্ড ব্যবহৃত হয়েছে যা তাপকে টেলিস্কোপের আয়নায় প্রভাব ফেলতে বাধা দেয়।

গত ১৪ জুলাই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা ১৩ শ ৫০ কোটি বছর আগের প্রাচীন মহাবিশ্বের তথ্যবহুল একটি ছবি যাতে মহাবিশ্বের প্রথমদিকে গঠিত হওয়া কিছু গ্যালাক্সি এবং একটি এক্সোপ্লানেটের ছবি প্রকাশিত হয়। অনেকের মনে হয়ত প্রশ্ন আসতে পারে অতীতের অবস্থার ছবি কিভাবে তুলতে সক্ষম হলো James Webb Space Telescope (JWST). কোনো বস্তু হতে আলো আমাদের চোখে এসে পরলেই কেবল আমরা ওই বস্তুকে দেখতে পারি। আমরা জানি আলোর গতির একটি সীমা আছে, কোনো বস্তু হতে যদি আলো আপনার চোখে পৌছাতে এক মিনিট সময় নেয় তার মানে আপনি ঠিক এই মূহুর্তে ওই বস্তুটির এক মিনিট আগের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেন। একই ভাবে মহাবিশ্বের শুরুর দিকের গ্যালাক্সিগুলোর থেকে নির্গত আলোকগুচ্ছগুলি যখন জেমস ওয়েবের লেন্সে ধরা পড়ল তখনই এই ছবিগুলো আমরা পেতে সক্ষম হয়েছি।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপকে একইসঙ্গে মহাবিশ্বের প্রাচীন অবস্থা অনুসন্ধান ও ধীমান সভ্যতার খোঁজে মহাকাশে স্থাপন করা হয়েছে। মহাকাশে জেমস ওয়েব কীভাবে এক্সোপ্লানেট অনুসন্ধান করবে? আগেই বলেছি এতে রয়েছে নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরার কথা, টেলিস্কোপটিকে যদি পৃথিবীর দূরত্বে রাখা হয় এবং একটি মৌমাছি যদি চাঁদে ঘোরাঘুরি করে তাহলে পৃথিবীর মত দূরত্বে থেকেই মৌমাছির শরীরের তাপমাত্রা মাপার মত সক্ষমতা আছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের।

এই সক্ষমতার জন্যই আমরা সন্ধান পেয়েছি WASP-96E এর মত জীবন ধারণে উপযোগী একটি গ্রহের, যা কিনা পৃথিবী থেকে ১ হাজার ১৫০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। টেলিস্কোপের ইন্সট্রুমেন্টগুলো থেকে প্রাপ্ত ডেটা ব্যবহার করে জানা গেছে, গ্রহটির তাপমাত্রা ৩৫৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই গ্রহ যখন কোনো নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘোরে তখন নক্ষত্রের আলো ওই গ্রহে থাকা বিভিন্ন পদার্থ দ্বারা প্রতিফলিত হয়। এই প্রতিফলিত আলোর বর্ণালি বিশ্লেষণ করেই জানা যায় তা কী ধরণের পদার্থের দ্বারা প্রতিফলিত হয়েছে। WASP-৯৬ই গ্রহটির বর্ণালি বিশ্লেষণে দেখা যায় সেখানে কার্বন-ডাই অক্সাইড, জলীয় বাষ্পের উপস্থিতিতে এ থেকে বিজ্ঞানীরা এ গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের ব্যাপারে আশাবাদী, যদিও বা মানুষের মত প্রাণি বসবাসে উপযোগী নয়। নক্ষত্রে সবচেয়ে কাছে অবস্থান করায় প্রায় ৩ দিনে ওই নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে থাকে। গ্রহটিতে দূষিত বায়ু না থাকায় পর্যবেক্ষণের জন্য আদর্শ মনে করছে বিজ্ঞানীরা। জেমস ওয়েবের পূর্বসূরী হাবল স্পেস টেলিস্কোপ প্রায় ৫ হাজারের মত এক্সোপ্লানেটকে চিহ্নিত করে রেখেছে। জেমস ওয়েবের মাধ্যমে হবে সেসব গ্রহের সূক্ষাতিসূক্ষ পর্যবেক্ষণ।

তবে কি আমরা বহিঃবিশ্বের কোনো ধীমান সভ্যতার সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হব? বিশাল ব্রহ্মান্ডে আমরা মানব জাতি কি একা? আপনার কী মনে হয়?

লেখক: মো. সামিউল ইসলাম, শিক্ষার্থী, পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রংপুর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পাতার শুরুতে